রূপকথার মতো শহর- প্রাগ


প্রাগ আমাদের কাছে ছিল যেন এক রূপকথার গল্পের মতো শহর। ড্রেসডেন থেকে যখন বাস ধরি, তখন ভেবেছিলাম আরেকটি নতুন শহরে যাচ্ছি। কিন্তু প্রাগ ছিল আমাদের কল্পনার চেয়েও বেশি কিছু।

বাস থেকে নেমেই এক অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। শহরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো আমরা ইতিহাসের পাতায় পাতায় হেঁটে চলেছি। পুরনো শহর, ঘোড়ায় টানা গাড়ি, চার্লস ব্রিজ, ভলতাভা নদীর জলের ওপর পড়া সূর্যের আলো সব মিলে মনে হলো ইতিহাসের গভীর কোনো অধ্যায়ের জীবন্ত স্মৃতিচিহ্ন। চার্লস ব্রিজকে শুধু ব্রিজ বললে ঠিক হবেনা। শতাব্দীর পুরোনো পাথর, দুই পাশে শিল্পময় ভাস্কর্য, আর ভলতাভা নদী যেন কল্পনার কোনও জগত।

চার্লস ব্রিজ পেরিয়ে আমরা পৌঁছলাম প্রাগ ক্যাসেলে। সেন্ট ভিটাস ক্যাথেড্রালের দিকে তাকালে থমকে যেতে হয়। সেই গথিক স্থাপত্য, বিশাল জানালা, আর রঙিন কাঁচের কাজ- সব কিছুর মধ্যে যেন আমরাও একটা জীবন্ত চিত্রকর্মের অংশ হয়ে যাচ্ছিলাম।

পথে পথে গান, গায়কদের দল আর চারদিকে ঘুরে বেড়ানো পর্যটকদের চোখে নতুন কিছু দেখার মুগ্ধতা, সবকিছু মিলিয়ে প্রাগ ছিল একটা উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চ। আমরা এক জায়গায় থেমে কিছুক্ষণ বাদ্যবাজনা শুনলাম, ‘প্রাগ ফানফেয়ার অর্কেস্ট্রা’ বলতে একটা দল গান গাইছিল।

আমাদের বাসের কিছু লোক মিলে আমরা এক রেস্তোরাঁয় গেলাম। ভেতরটা স্থানীয় ধাঁচে সাজানো। চারদিকে ছড়ানো কাঠের টেবিল চেয়ার, দেয়ালজুড়ে ঝোলানো প্রাগের পুরনো দিনের ছবি, চার্লস ব্রিজ, প্রাসাদ, আর সেকালের শহরের ছবিই সব। এখানকার একটা বিশেষ খাদ্য গুলাশ। এক ধরনের ঘন মসৃণ ঝোলের সঙ্গে নরম করে রান্না করা গরুর মাংসের টুকরো এই গুলাশ। আর পাম্পকিন স্যুপ। কুমড়ো আর আলু দিয়েও যে এত চমৎকার স্বাদের স্যুপ হয় সেটা সেবারই প্রথম জানলাম।

পুরনো শহরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে এলাম প্রাগের বিখ্যাত অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ক্লকের সামনে। ওল্ড টাউন স্কয়ারের প্রাণকেন্দ্রে দাঁড়িয়ে থাকা এই ঘড়ির প্রতি ঘণ্টায় বেজে ওঠার শব্দ শোনার জন্য জড়ো হচ্ছিল পর্যটক ও স্থানীয়রা । ১৪১০ সালে নির্মিত হয়েছিল এই ঘড়ি, এবং ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ক্লক যেটা এখনও কাজ করছে। এই ঘড়ি নাকি কেবল ঘণ্টা আর মিনিটই দেখায় না, এটা সূর্য ও চাঁদের অবস্থান, রাশিচক্রের সাইন, এমনকি দিন-রাতের দৈর্ঘ্যও দেখায়। 

কথিত আছে, এই ঘড়ি যদি কখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে প্রাগ শহর নাকি এক বিশাল বিপদের মুখে পড়বে। এই কারণেই ঘড়ি যতই পুরনো হোক না কেন, এটা সচল রাখতে সবসময় বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়।


নির্ধারিত সময়ে ঘড়ি সেই ঘণ্টার কাটা পূরণ করে শব্দ করে বেজে উঠল। আমরাও সবার মতো সেখানটায় দাঁড়িয়ে সেটা প্রত্যক্ষ করলাম। তারপর মিনিটকয়েক পরে সবাই আস্তে আস্তে যে যার মতো আবার ছড়িয়ে পড়তে লাগল। আমরাও সবার সাথে আমাদের মতো ছড়িয়ে পড়লাম। কতক্ষণ পর হাঁটতে হাঁটতে আবার চার্লস ব্রিজ পার হয়ে ভলতাভা নদীর আরেক দিকে চলে আসলাম। বিকেল নাগাদ আমাদের বাসের লোকজন ভলতাভা নদীর তীরে আমাদের বাসের কাছে এসে জড়ো হতে লাগল। এক সময় ফিরে আসারও সময় হয়ে এলো।  




১০ ডিসেম্বর ২০১৮

উমিও, সুইডেন