বুনো বাফেলো যেমন এক প্রান্তর থেকে আরেক প্রান্তরে ছুটে যায় খাদ্যের খোঁজে, স্যামনের দল পাহাড়ি স্রোতে ভেসে ফিরে যায় তাদের জন্মভূমিতে, পাখিরা যেমন ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে মাইলের পর মাইল পাড়ি দেয়, সাভানার বুনো জেব্রার দল হাজার হাজার মাইল অতিক্রম করে শুধু বর্ষার জলের খোঁজে, তেমন মনার্ক প্রজাপতিও, লেক সুপিরিয়র পার হয়ে উষ্ণ প্রকৃতির খোঁজে ছুটে চলে মেক্সিকোর ওয়ামেল অরণ্যে। জীবের চলার এই প্রবৃত্তি, অভিবাসন ও অভিযোজনের গভীর শিকড়ে প্রোত্থিত।
মানুষ, সেই একই ছন্দে, হেঁটে গেছে ভূ-পৃষ্ঠের কঠিন পথ ধরে, ভেসেছে সমুদ্রের বিশাল ঢেউয়ের বুকে, ছুটেছে অজানা প্রান্তরের দিকে। সবই বেঁচে থাকার জন্য, নতুন সম্ভাবনার জন্য। আমাদের রক্তে মজ্জায় যেন খোদিত এই চলার গল্প। আমাদের শিরায় শিরায় বয়ে চলেছে অগণিত প্রজন্মের অভিবাসী পূর্বপুরুষদের রক্ত।
যে ভূমিকে আমরা আজ "আমাদের" বলি, সেটি কোনো না কোনো সময়ে অন্য কারও ছিল। আজ থেকে হাজার বছর পর আবারও মানুষ বলবে- যে ভূমিকে আমরা আজ "আমাদের" বলি, সেটি কোনো না কোনো সময়ে অন্য কারও ছিল।
অভিবাসনের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্র বদলেছে, ভাষা মিশেছে অন্য ভাষায়, সংস্কৃতি রূপান্তরিত হয়েছে, এক জাতি থেকে অন্য জাতির সঙ্গে মিলে মানুষ গড়ে তুলেছি নতুন সভ্যতা। মানুষ আসলে পথিক। ঘর বদল, দেশ বদল, বেশ বদল, নতুন জায়গায় নতুন করে শুরু করার ইচ্ছা, এই সবই মানুষের পথিক জীবনের অনুষঙ্গ। আর অভিবাসন, আদতে, মানব অস্তিত্বের জন্মদাগ!
-
একটি তুষার-ঢিবির মনোবৃত্তান্ত
দুইদিন আগেই ছিল এক শীতার্ত পূর্নিমা। চাঁদের কাছেপিঠে এক জোড়া তারাও জ্বলজ্বল করিতেছিল দক্ষিনাকাশে। আজ কিন্তু আবহাওয়া একেবারে অন্যরকম হইয়া গিয়াছে। পুঞ্জীভূত ধূসর মেঘের শান্ত প্রকৃতি অকস্মাৎই যেন কোনও চিত্রকরের আঁকা শীতের ছবির মতো একের পর এক ব্রাশের স্ট্রোকে ক্রমাগত বদলাইয়া যাইতেছে।
মেঘেরসমুদ্র হইতে প্রবলপরাক্রমে নামিয়া আসিতেছে তুষার। ইহাকেই কি তুষারঝড় বলা হইয়া থাকে? দিগন্তস্পর্শী আশ্চর্যদৃশ্য। সাদা রঙের আকাশে দুইদিন আগের সেই তারা দুইটির কোনও নাম গন্ধ আজ দেখা গেল না। এই আকুল হইয়া ওঠা বিমাতাসুলভ প্রকৃতির রূপ আন্দাজকরিয়া বহু আগেই পার্থিব চরাচরের সকল জীব যখন নিরাপদ আশ্রয়ে পলাইয়া বাঁচিয়াছে, তখন এরই মাঝে দেখিলাম কে বা কারা হাঁটিতেছে অন্তহীন দিগন্তের দিকে। উহারা কি মানব সমাজের কেউ? মানব ব্যতিরেকে অন্য কোনও সম্প্রদায়ের মধ্যে আমি এইরুপ নির্ভীকতা দেখিনাই। তাই তাকাইয়া রহিলাম, বুঝিবার চেষ্টা করিতেছিলাম কাহারা আসিতেছে, কেনইবা আসিতেছে! উহারা কি ঘুণাক্ষরেও বোঝে না এই অপরিনামদর্শীতার ফল কি হইতে পারে! দেখিয়া একবার মনে হইল - উড়িতেছে যেন উহারা, যেন ভিন্ন জগতের জীব।
ঘূর্ণি হাওয়ায় শোঁ শোঁ বেগে তুষারকণা ভাসিয়া সূঁচের মতো বিঁধিতেছে চোখে, দেখিতে পারিতেছি না ভালো করিয়া, চারিপাশে শুধু ধূসর সাদা ধূম্রজাল। অত:পর ধীরে ধীরে ঠাহর হইতেছে- উহারা মানুষই হইবে। ওই যে দেখিতে পাইতেছি দুইখানা পা, দুইখানা করিয়া হাত। চারিটি মানুষ। দেখিয়া মনে হইতেছিল, যেন ক্রমধাবমান হিমবাহের বুক চিরিয়া বাহির হইয়া আসিতেছে চাবি দেওয়া চারিটি পুতুল। বেগবান তুষারের ধূম্রজালে বোধ হইতেছে উহাদের শরীর যেন মাটির কাছে কাছে উড়িয়া চলিতেছে।
আমি মহাকালের যাত্রা পথে বহুলোকের আসা যাওয়া দেখিয়াছি এই পথে। হলফ করিয়া বলিতে পারি তুষারঝড়ের এই ঘূর্ণি এই চারিটি লোক এর আগে কোনওদিন দেখেনাই। ইহাদের মধ্যে দেখিলাম দুইজন পূর্নবয়স্ক মানুষ। তাহাদেরএকজন শাপটাইয়া ধরিয়া আগাইতেছে নয় দশ বছরের একটি শিশু। আর একজন মানুষ বুকে জড়াইয়া আগাইতেছে একটি ক্ষুদে শিশু। ধুঁকেধুঁকে আগাইতে আগাইতে উহারা প্রায় আমার সম্মুখে আসিয়া পড়িল। দেখিয়া মনে হইল চাবি দেওয়া পুতুলের দম একেবারে ফুরাইয়া আসিয়াছে। একটু উষ্ণশ্বাস লইবার চেষ্টায়ই বুঝি কখনও এদিক কখনও ওদিক করিয়া হাঁটিবার চেষ্টা করিদেলছিল উহারা। কিন্তু উষ্ণশ্বাস মিলিবে কোথায়! উহাদের বোধ হইতেছে হাতের আঙুল থাকিয়া হাড় খসিয়া পড়িয়াছে যেন। হাঁটুঅব্দি তুষার ঠেলিয়া তখনও উহারা হাঁটিতেছিল। চলিতে থাকা শরীর তাপ তৈয়ার করিতেছিল তখনও। তখনও পা বিবশ হয় নাই। তবে মুখের ভেতরটা খসখসে হইয়া আসিয়াছে।
প্রবলবেগে তুষারের পাক কোথাও থামিতেছে, আবার বিস্তীর্ণ ধবলভূমি থাকিয়া আরও আরও তুষারের স্তর তুলে মোচড় দিতে দিতে উঠিয়া আসিয়া আবার ধাবিত হইতেছে যেন উহাদেরই পানে। দশ হাত দূরের জিনিসও আর দেখা যাইতেছে না।
প্রকৃতি যখন রুদ্র হয় তখন সে কী অবিশ্বাস্যক্ষমতায় অসহায় জীবাধারকে নিকুচি করতে পারে কস্মিনকালে কি তা আগে হইতে টের পাওয়া যায়? বাঁচিয়া থাকার দৃঢ় সংকল্প যেন তুরির মতো উড়িয়া যায়। প্রকৃতির আক্রমণের ক্ষমতা সময়ে সময়ে এতই তীব্র হইয়া ওঠে যে, জীবেকূলের সমস্ত প্রতিরোধ যেন মুহূর্তে ভাঙ্গিয়া পড়ে। এইসবই তো দেখিয়া আসিতেছি।
অসহায় মানবের অস্তিত্ব প্রকৃতির নিঃসীম দৌরাত্ম্যের নিকট এতটাই ক্ষুদ্র যে, তা কস্মিনকালেও পূর্ব হইতে উপলব্ধি করা হইয়া ওঠে না। বাঁচিবার যে দৃঢ় সংকল্প, যাহাকে মানব তাহার অন্তরের গভীরতম প্রেরণার সহিত সর্বদা আঁকড়াইয়া রাখে, সেই সংকল্প, সেই একই সংকল্প প্রকৃতির এহেন রুদ্রতার সম্মুখে পড়িলে, নৈঃশব্দ্যে, তুরির মতো এক ফুঁৎকারে বাতাসে মিলাইয়া যায়। এক অপার্থিব শক্তি প্রমাণ করিয়া দেয় জীব মাত্রই ক্ষুদ্র। মানবমাত্রই তুচ্ছ। ইহাই তো দেখিয়া আসিতেছি।
হাড়কামড়ানো ধারালো বাতাসে এতক্ষণে মানুষগুলির নাকেরঝিল্লি ফাটিয়া গিয়াছে। হিমধরা হাত পায়ের আঙ্গুল গুলিতে চির ধরিয়াছে। নিজের শরীর উহাদের নিজের কাছেই অতি অপরিচিত লাগিতেছে। ধীরে ধীরে ফুসফুসটা যেন গলার কাছে উঠে আসিয়াছে বলিয়া উহাদের বোধ হইতেছে। হিমবাতাস হইতে দম নেওয়ার তীব্র ছটফটানিতে যখন এককিস্তি দুই কিস্তি তিন কিস্তি করিয়া শ্বাস টানিতে হয়, তখন একটা মুহূর্ত আর একটা আদিঅন্তহীন মহাকাল মিলিয়া মিশিয়া এক হইয়া যায়।
দম্পতির ছোট্ট শিশুটি যাহার বয়স তিন বৎসর, উহা একবার পিতার একবার মাতার কোলে কোলে আগাইতেছিল, উহাকে যেহেতু হাঁটিতে হয় নাই, তাই উহার শরীর একেবারেই তাপ উৎপাদন করিবার অবকাশ পায় নাই, সবার মধ্যে তাই উহাই প্রথমে জমিয়া গেল। তারপর জমিয়া গেল বড় শিশুটি যাহার বছর নয় বৎসর। শিশু দুইটির নাক আর ঠোঁট হঠাতই খটখটা শুকনা হইয়া উঠিল।
মানুষের যেহেতু ভাবার ক্ষমতা রহিয়াছে, তাই সে বুঝিতে পারে, যা ভাবা হয়না, যে ভাবনার জন্য প্রস্তুতি থাকে না, সেই ভাবনা বহু সম্ভাবনার জাল কাটিয়া গুটি গুটি পায়ে সন্তোর্পনে সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হয়। তাই আজ এইখানে এই দম্পতি যাহা কোনোদিন ভাবিয়া ওঠে নাই, তাহাই হইল। ক্রোধোন্মত্ত উত্তাল প্রকৃতির মধ্যখানে সামান্য খানিকটা উষ্ণ শ্বাসেরর জন্য উহারা বেপোরোয়া হইয়া উঠিল, শীতল ঝাঁঝালো ঢেউয়ের দমকে সন্তান দুইটিকে দৃঢ় করিয়া আঁকড়াইয়া ধরিয়া বসিয়া পড়িল- অপেক্ষা করিবে। উহাদের কেউ কি বলিতেছে কিছু? ডাকিতেছে কাহাকেও? মুখেরপেশী নড়িতে দেখি নাই, তবে বোধ হইল- শুনিলাম কিছু। উহাদের সেই অস্পষ্ট ক্ষীণস্বর আমার কানে অশরীরীর বিলাপের মতো ঠাহর হইল। সেই শব্দ ছাপাইয়া দূরের পাইন বনের গাছে গাছে ঘষাঘষির শোঁ শোঁ শব্দও শুনিতে পাইলাম। শান্তদৃঢ়তায় স্থির হইয়া শিশুদুইটির পাশে শুইয়া দম্পতি এইবার অপেক্ষা করিতে লাগিল।
এই নিস্তব্ধ মধ্যরাতের সমস্ত হাঁসফাঁস একে একে মিলাইয়া গিয়াছিল। এক সময় আমার তন্দ্রামত আসিয়াছিল। পরেরদিন যখন সূর্যোদয়ের সময় ঘনাইতেছিল, দূরসীমানায় সূচিমুখ কালচে সবুজ পাইন বনের শাখায় শাখায় যখন তুষারে মাখামাখি ম্লান আলো উত্থিত হইতেছিল, তখন ধীরে ধীরে জাগিয়া উঠিতেছিলাম। হঠাতই মনে পড়িল গতরাতের ঘটনাটি। বেশি খুঁজিতে হইল না। নিকটেই দেখিতে পাইলাম, প্রত্যন্ত আদিম আভা ছড়ানো ধু ধু ভূমিও দেখিল, একটি দম্পতি দুইটি শিশুকে জাপটাইয়া পড়িয়া আছে। শান্ত ঝিকিমিকি হিমায়িত জলের মতোই উহাদের ভঙ্গুর শরীর।
(১৯ জানুয়ারি ২০২২ ইউএসএ-কানাডা সীমান্তের ম্যানিটোবা প্রদেশের একটি বর্ডার-ট্রাজেডি অবলম্বনে)