দোআনি থেকে নারায়ণগঞ্জে আসবার আগে আগে, তখন ক্লাস ওয়ানে পড়ি। আমরা তখন লালমনিরহাটে এসে খালামনিদের বাসায় উঠলাম। সেজ খালামনির কাছে আমি থাকতাম। সেজখানামনির বাসায় থাকতাম না বলে সেজখালামনির কাছে থাকতাম বলাটাই বেশি উপযুক্ত। সেজখালামনির গা সেঁটে থাকতাম।

লালমনিরহাট গার্লসস্কুলে সাময়িকভাবে ভর্তি হয়েছিলাম তখন। স্কুলে খালামনির ছাত্রীদের মধ্যে শিখা আপু আর জেনেভা আপু আমাকে খুব স্নেহ করত। কিভাবে কিভাবে আমার ভাগ্যে এইসব সাহায্যকারী জুটে যায়। স্কুলে যেতামই শিখা আপু আর জেনেভা আপুর আকর্ষনে। সেজ খালামনি আমাকে শিখা আপু জেনেভা আপুর দায়িত্বে ছেড়ে দিল। ওরা দুজন আমাকে স্কুলের যাবতীয় খেলায় ঠেলে ঠলে ঢুকিয়ে দেয়। লং জাম্প, হাই জাম্প, দৌড়, উপস্থিত কিছু একটা লেখা এইসবে আমার জীবন অতিষ্ট করে তুলেছিল শিখা আপু আর জেনেভা আপু।

একবার 'যেমন খুশি তেমন সাজো' পালা আসলো।  খালামনি শিখা আপু আর জেনেভা আপুকে দায়িত্ব দিল। শিখা আপু, জেনেভা আপু মিলে আমাকে গরিবের রাজা রবিনহুড সাজাল। তারপর এক সময় মুখের সামনে মাইক ধরল কেউ। কিছু একটা নাকি বলতে হবে। আমি কি বলব! আমি ক্লাস ওয়ানের বাচ্চা, আমি রবিনহুডের কি বুঝি। শিখা আপু আর জেনেভা আপু মিলে কানের পেছন থেকে ফিসফিস করে প্রম্পটিং করল- বলো : 'আমি গরীবের রাজা রবিনহুড'। আমি বললাম 'আমি গরীবের রাজা রবিনহুড' ওরা বলল- বলো, 'আমি প্রেমের নই, আমি বিদ্রোহের।'  আমি বললাম 'আমি প্রেমের নই, আমি বিদ্রোহের।'

ওরা বলল- বলো, 'আমার তীর ছুটে যায় অসত্যের দিকে, আমার ধনসম্পদ তোমাদের সাথে ভাগ করি....।'  আমি বললাম। ওরা বলল- বলো, 'আমার জীবনের দুঃখ আর বেদনাকে অন্ধকার রাতের মতো আড়াল করে রাখি।' আমি বললাম... 'আমার জীবনের দুঃখ আর বেদনাকে অন্ধকার রাতের মতো আড়াল করে রাখি।' ওরা বলল- বলো, 'তোমাদের সুখের মাঝে আমি সুখ খুঁজে পাই। তোমাদের নতুন আশা নতুন স্বপ্নের রাজ্যে আমি তোমাদের রাজা, আমি তোমাদের আপন জন'। আমি বললাম, 'তোমাদের সুখের মাঝে আমি সুখ খুঁজে পাই। তোমাদের নতুন আশা  স্বপ্নের রাজ্যে আমি তোমাদের রাজা, আমি তোমাদের আপন জন'।

সেজ খালামনি কি যে খুশি হলো, বাসায় ফিরে আমার যে কি প্রশংসা। আমি গর্বে ফুলে উঠলাম। মানুষের যে কোনও কাছের মানুষকে নিয়ে একটা সবচেয়ে প্রথম জ্বলজ্বলে স্মৃতি থাকে। এই রবিনহুডের ব্যাপারটা সেজ খালামনি, শিখা আপু আর জেনেভা আপুর কোলাবরেশনের আমার সবচেয়ে প্রথম জ্বলজ্বলে স্মৃতি।

সেজ খালামনিকে নিয়ে সবচেয়ে শেষ স্মৃতি কিছুদিন আগে ভিডিও কলে বাসাটা ঘুরে ঘুরে দেখালাম এটাই। খালামনি, তোমার একটা মিষ্টি মুখ একটা মিষ্টি হাসি এই চেহারাটাই মনে থাকবে চিরদিন, কোনও মৃত মুখ না।

দেশের এই সার্বিক পরিস্থিতিতেও আমি নিজের ব্যক্তিগত দুঃখ বেদনাকে অন্ধকার রাতের মতো, রবিনহুডের মতো আড়াল করে রাখতে কিছুতেই পারলাম না। এসে বলে গেলাম। আমি তো আর রবিনহুড না।

ওপারে ভালো থেকো, প্রিয় খালামনি। আমি জানি তুমি আছো কোথাও না কোথাও... আমার এই লেখা দেখে মিষ্টি মিষ্টি হাসছো...



২৪ জুলাই ২০২৪