য়শা আপার কথা বলব। সময়ের পরতে পরতে কত স্মৃতি চাপা পড়ে গেছে, কত মুখ ঝাপসা হয়ে গেছে, কিন্তু চৌত্রিশ বছর আগের সেই সময়টা আজও যেন জ্বলজ্বল করে। প্রত্যেকের জীবনেই কিছু নাম আছে, কিছু হারিয়ে যাওয়া মুখ আছে, যেগুলো শুধু স্মৃতিতে না, জীবনের শিরায়-উপশিরায় মিশে থাকে। কোনো বৃষ্টির সকালে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বা শীতের বিকেলে ম্রিয়মান সূর্যের অস্পষ্ট আলোয়, কিংবা দূরদেশের কোনো নদীর ধারে হাঁটতে হাঁটতে, অথবা কোনও ধোঁয়াটে সন্ধ্যার আকস্মিক ঘ্রাণে, কিছু মানুষের কথা আকস্মিক ভাবেই মনে পড়ে। আয়শা আপা আমার জীবনে তেমনই এক নাম; স্বল্প সময়ের জন্য আসা একটা শান্ত নদী - আজ এতকাল পরে যে নদীর জলের শব্দ আর শোনা যায় না, কিন্তু তার স্রোত মনের গভীরে এখনও বয়ে যায়।


দোআনি থেকে নারায়ণগঞ্জে আসার কিছুদিন পরের কথা। বাবার বদলির চাকরির কারণে আমরা নতুন শহরে, নতুন পরিবেশে এসে উপস্থিত হয়েছি। আমার স্কুলের নাম বিবি মরিয়ম স্কুল। নতুন স্কুল একদমই ভালো লাগত না। সারাক্ষণ ভয়ে গুটিয়ে থাকতাম। ক্লাসের সবাই যেন পড়াশোনার যন্ত্র। আর আমি? গ্রামের জংলি ফুলের মতো সেই শহুরে বাচ্চাদের মাঝে ভীষণ একা।


শহরের দালানকোঠা, বিদ্যুতের তার, ল্যাম্পপোস্ট, মানুষের নিঃশ্বাস, চানাচুরওয়ালা, হটপেটিস, রাস্তার ধুলোমাখা বাতাস - সবকিছুই আমার কাছে একরকম গন্ধ হয়ে ধরা দিত। তারপর সেই গন্ধ, ভ্যানে সাজানো শাকসবজি, ফেরিওয়ালার কালো সাবান, ভ্যানচালকের পরিশ্রমী দেহ আর দোকানের চায়ের গন্ধের সঙ্গে মিলেমিশে, শিল্পনগরীর ধাতব ধূসর ধুলো সাথে করে, কাঁটাবেগুন আর ল্যান্টানার ঝোপের ওপর দিয়ে শীতলক্ষ্যার বুকে মিলিয়ে যেত। রোজ সকালে সহজাত সেই গন্ধ নাকে আসতেই মনের ভেতরটা কি এক অজানা কারণে কেঁপে উঠত।


ওই চঞ্চল শহরে দূর গ্রামের চরাঞ্চল থেকে উঠে আসা আমি এক ক্ষুদ্র মানুষ। স্কুলে কে বসবে আমার পাশে? কে কথা বলবে আমার সঙ্গে? আর আমার বাম চোখ, কখনও কি ঠিক হবে? এই চোখ দিয়ে আর কোনওদিন দেখতে পাব? দেশবন্ধু চক্ষু হাসপাতালের বৃদ্ধ ডাক্তার যা বলেছেন, তা কি সত্যি হবে? দেড় মাস পরে চোখের ব্যান্ডেজ খোলা হবে। ততদিন এইভাবেই থাকতে হবে? এক চোখে ব্যান্ডেজ নিয়ে দেড় মাস! দেড় মাস কত লম্বা সময়? স্কুলে যদি যেতে না হতো এর মধ্যে! স্কুলে না যাওয়ার যদি কোনো উপায় থাকত!


ক্লাসের অন্যরা আমাকে দেখে হাসত। ভাবতাম, ওরা কি জানে না কারও চোখে ব্যান্ডেজ থাকলে তাকে নিয়ে হাসা ঠিক না? আম্বিয়া আপা (ছদ্মনাম) নামে একজনের ক্লাস থাকত। র‍্যাপিড রিডিং-এর আমার অংশ আসলে আমি অনেক কায়দা-কসরত করে, শব্দটা কি হতে পারে, বাক্যটা কোথায় শুরু হতে পারে, এইভাবে ভেবে চিন্তে আল্লাহ-খোদা করতে করতে পড়া শুরু করতাম, বইটা চোখের খুব কাছে ধরে। কারণ সকালে ভালো চোখটায় ওষুধ দিয়ে আসতে হতো। ওষুধটা দিয়ে স্কুলে আসার পর থেকেই ধীরে ধীরে একটা বিশেষ ক্লাসের সময় অর্থাৎ আম্বিয়া আপার ক্লাসে এসে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যেত। পরের ক্লাস আসতে আসতে সেই দৃষ্টি ফিরতে শুরু করত। এই সমস্যার সমাধান কি, তা আমার জানা ছিল না।


এই সমস্যার কথা বাসায় বললে, অথবা স্কুলে বললে হয়তো তারা বুঝত এবং আমাকে কিছুদিন স্কুলে পাঠানো বন্ধ রাখত, কিন্তু সেই সময়ের অল্প বুদ্ধিতে এই কথা আমার মাথায়ও আসেনি। আমি ধরে নিয়েছিলাম এটাই জীবন এবং বাকি জীবন আমাকে এইভাবে কাটাতে হতে পারে। তাই ওই দেড় মাস এক চোখে ব্যান্ডেজ নিয়ে আমি নিয়মিত স্কুলে যেতাম এবং আম্বিয়া আপার ক্লাসে ভীষণ মানসিক কষ্টে থাকতাম। আম্বিয়া আপাকে সঙ্গত কারণেই সবাই ভয় পেত।


হীরা নামে একটা মেয়ে একদিন আমার পাশে বসেছিল। সেদিন আম্বিয়া আপার ক্লাসে আমি ভয়ে শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে গেলাম। সেদিন ওষুধের প্রভাবেই সম্ভবত, ভালো চোখটাও যেন পুরোপুরি অন্ধ। হীরাকে বললাম সেকথা। হীরা পাল্টা কিছু জিজ্ঞেস করল না, যেন চোখে না দেখা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। বলল, ‘প্রত্যেকে চার লাইন করে পড়বে, দেখি, তোমার ভাগে কোন লাইন আসে, দেখি।’ বলেই আমার সামনে যে কয়জন ছিল, সেই অনুযায়ী হিসাব করে আমার লাইনগুলো বের করে ফেলল। আমাকে আমার ভাগের চার লাইন হীরা ফিসফিস করে পইপই করে পড়ে শুনাল।


আম্বিয়া আপা যদি কোনোভাবে খামখেয়ালি হয়ে কোনও একবার জানালার দিক থেকে শুরু না করে আইলের দিকের ছেলে মেয়েদের পড়ার নির্দেশ দিতেন, তাহলে কি যে হতো, সেই কথা ভাবার উপায় আমার ছিল না। কিন্তু আম্বিয়া আপা যথারীতি নিয়ম বজায় রেখেছিলেন। এবং হীরার বুদ্ধিতে আমি সেদিন চোখে না দেখেও র‍্যাপিড রিডিং-এর ক্লাসে রিডিং করে কোনওমতে পার পেয়ে গেলাম।


যাই হোক। আমার বাঁ চোখের ব্যান্ডেজ দেড় মাস পরে খুলল। যে বৃদ্ধ ডাক্তারটির নাম আজ আর মনে নেই, যাকে তিন দশকেরও বেশি সময়ে বহুবার মনে পড়েছে, তাঁর কাজ আর তার আত্মবিশ্বাসী সান্ত্বনা বেঁচে আছে আমার সেই সময়ে প্রায় হারানো বাম চোখের নতুন দৃষ্টিতে।


আয়েশা আপার কথা আমি শুরুতে বলতে চেয়েছিলাম। সেইখানেই ফিরে আসি। আয়েশা আপার সঙ্গে আমার মায়ের পরিচয় হয়েছিল। আয়েশা আপা আমাদের শ্রেণির কোনো শিক্ষক ছিলেন না, তবে অন্য শ্রেণির শিক্ষক ছিলেন। তাঁর সাথে মা’র কোনোভাবে স্কুল প্রাঙ্গণে পরিচয় হয়েছিল। আপা প্রায়ই আমাকে স্কুলে খুঁজে নিতেন। টুকটাক গাইড করতেন। তিনি কেন যেন আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমি তখন ছোট মানুষ, তাই আমার দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন অনেক লম্বা, একহারা গড়ন, শ্যামলা বর্ণ, মুখে সব সময় একচিলতে হাসি লেগে থাকত।


ছায়া আর ছবি নামে আপার দুই ভাগ্নী ছিল, সম্ভবত অষ্টম কিংবা নবম শ্রেণিতে পড়ত। একবার আমরা আয়েশা আপার বাসায় গিয়েছিলাম। ফেরার আগে আগে ছায়া আর ছবি নামের আপু দুজন আমাকে কাগজে মাছ, ফুল, গ্রামের দৃশ্য এঁকে দিয়েছিল।

একদিন স্কুলে আয়েশা আপা আমাকে ডেকে বললেন, ‘শোনো, রচনা প্রতিযোগিতা হবে, তুমি নাম দিও।’

‘রচনা প্রতিযোগিতা কি, আপা?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

আপা বললেন, একটা বিষয় দেওয়া হবে, সেই বিষয়ে সুন্দর করে কিছু লিখতে হবে। সময় এক ঘণ্টা।

‘কি লেখতে হবে, আপা?’

‘ক্লাসে ক্লাসে নোটিশ যাবে আজকেই, তোমাদের ক্লাসের বিষয় - আরবের অন্ধকার যুগ। তোমার মাকে বলো, নোট করে দেবে, সেটা ভালো করে পড়ে সেই মতো লিখবে।’

আমার ছয়-সাত বছরের জীবনে তখন পর্যন্ত শুধু ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম। চেয়ারম্যান প্রার্থী হয়ে ফিডার মার্কায় দাঁড়িয়েছিলাম, স্থানীয় পরিবারগুলোর শিশুদের ফিডারের চাহিদা পূরণ করব এই আশ্বাসে দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চেয়েছিলাম। তখন আমরা দোআনিতে থাকতাম। আমার বয়স ছিল তিন-চার বছর। প্রথম পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলাম একটা কস্কো সাবান। তারপর, দোআনি থেকে নারায়ণগঞ্জে আসার আগে, প্রথম শ্রেণিতে পড়াকালীন আমরা লালমনিরহাটে খালার বাড়িতে উঠেছিলাম। সেখানে লালমনিরহাট গার্লস স্কুলে সাময়িকভাবে ভর্তি ছিলাম কিছুদিন। খালামণির ছাত্রীদের মধ্যে শিখা আপু আর জেনেভা আপু আমাকে খুব স্নেহ করত। ওরা আমাকে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’ প্রতিযোগিতায় সেবার গরিবের রাজা রবিনহুড সাজিয়েছিল। আমি যেমন খুশি তেমন সাজো’ ভালো পারতাম। কিন্তু রচনা প্রতিযোগিতা কি জিনিস, সেটা জানতাম না। তাই ব্যাপারটা খুব একটা সুবিধার মনে হলো না। কিন্তু রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ না নিলে আয়েশা আপা মন খারাপ করতে পারেন, তাই শুধু আপার কথা চিন্তা করে আমি প্রতিযোগিতায় নাম দিলাম।


মা-মেয়ে কঠোর অধ্যাবসায়ের পর নির্ধারিত দিনে আমি প্রতিযোগিতায় অংশ নিলাম। আরবের অন্ধকার যুগ নিয়ে, ধূসর মরুর রূক্ষ পরিবেশ নিয়ে, গোত্রীয় সংঘাত নিয়ে, কন্যাশিশুর নিষ্ঠুর পরিণতি নিয়ে, নবী করিম (সাঃ)-এর মাথার ওপর আল্লাহ প্রদত্ত একখণ্ড মেঘ নিয়ে, নবীর আগমন যেন মরুর তপ্ত বালির মাঝে শীতল ঝর্ণার স্পর্শ ইত্যাদি ইত্যাদি নিয়ে সদ্য অর্জিত সবটুকু জ্ঞান কলমে ঝরিয়ে পুরস্কারও জিতলাম। পুরষ্কার হিসেবে পেলাম দুইটি বই - ঠাকুরমার ঝুলি আর আরব্য রজনীর এক হাজার এক রাত্রির গল্প। শুরু হল আমার জীবনের এক রঙিন অধ্যায়।


যাইহোক, সেইদিন প্রথম আমি জানতে পেরেছিলাম, মানুষ কোনও একটা কিছু নিয়ে কোনও একটা কিছু লিখতে পারে। আরবের অন্ধকার যুগ- ছিল আমার জীবনের প্রথম লেখা। শৈশবের আঙিনায়, শব্দের বীজতলার পাশে দাঁড়িয়ে ~ আপনার প্রথম লেখা কোনটি ছিল- আজ মনে পড়ে কি?