মানুষের দীর্ঘ যাত্রা কেবল ভৌগোলিক না, মানসিকও। উত্তর ও দক্ষিণের দুই ভুবনের অভিজ্ঞতা থেকে আজ আপনাদের বলব দুটি ভিন্ন জানালার কথা। জানালা দুটি ভিন্ন হলেও আদতে ওরা একই যাত্রার দুই দিক । একটা অনেকটা বাহিরমুখী, অন্যটা অনেকটা অন্তরমুখী।
অস্ট্রেলিয়া আপনাকে শেখাবে Our Common Bond। এটা কোনো মুখস্থ নিয়ম না, এটা একটা গভীর বোধ। আইন মানা এখানে কেবল শাস্তির ভয়ে নয়, বরং অন্যের অস্তিত্ব ও অধিকারকে স্বীকার করার বিনয় থেকেও। গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট না, বরং অন্যের মতামতকে নিজের সমান মর্যাদায় রাখা। সমতা মানে কেবল অধিকার ভাগাভাগি না, বরং স্বীকার করা - অন্যের বেঁচে থাকাও আমার বেঁচে থাকার জন্য ইম্পরট্যান্ট, এবং ভাইস ভার্সা। আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার মূল শিক্ষা হলো, আমরা যত ভিন্ন উৎস থেকে আসি না কেন, শেষ পর্যন্ত আমরা একই সেতুর উপর দাঁড়িয়ে আছি। অস্ট্রেলিয়ার কমন বণ্ড তাই কেবল একটা নাগরিক চুক্তি না, এটা একটা বাহিরমুখী আধ্যাত্মিকতা- যেখানে স্বাধীনতা, শ্রদ্ধা, ন্যায়, সমতা আর আইনের শাসন মানুষকে একসাথে বেঁধে রাখে। অন্যকে রক্ষা করে নিজেকে রক্ষা করো, নিজেকে রক্ষায় অন্যকেও রক্ষা করো।
অন্যদিকে সুদূর উত্তরের, সুইডেনে, আমাদের ল্যাংগুয়েজ ক্লাসে শেখা যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটা আজও মনে গেঁথে আছে, সেটা হলো - Stick inte ut, বাংলায় অর্থ করলে দাঁড়ায় - আলাদা করে চোখে পড়ো না। কি অদ্ভুত কথা!
জেনার্যালি, বাংলাদেশে বড় হওয়া বাচ্চারা শেখে, আলাদ হও, আলাদা হও, ওকে দেখে শেখো, ওর মতো হও, ওর চেয়েও ভালো হও। স্কুলের বেঞ্চ থেকে শুরু করে চাকরিতে, সমাজে - সবখানেই। সেখানে বেঁচে থাকার মানে হলো সবার থেকে এগিয়ে থাকা। চোখে পড়ো, সবার চোখে পড়ো। কোন পদে আছো, কত বেতন পাও? বাড়ি কই, উত্তর বঙ্গ, দক্ষিণ বঙ্গ ইত্যাদি...
ছোট চাকরি করো? ঐযে ওইখানে বসো, সরে দাঁড়াও, চোখ তুলে কথা বলো না, কাচুমাচু কর।
সুইডেনের সেই Stick inte ut, মানে অতিরিক্ত আলাদা হয়ো না ব্যাপারটা একটা সুইডিশ সামাজিক মনোভাবের প্রতিফলন। এই মনোভাব উৎপত্তির গভীরে আছে “ইয়ান্তেলগেন” নামক এক সাংস্কৃতিক ধারণা। “ইয়ান্তেলগেন” ধারণাটা প্রথম জনপ্রিয় হয় ড্যানিশ-নরওয়েজিয়ান লেখক অ্যাক্সেল সানদেমোসে এর ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত উপন্যাস En flyktning krysser sitt spor (A Fugitive Crosses His Tracks) - এ। এই বইয়ে লেখক একটা কাল্পনিক ছোট শহরের নিয়ম-কানুন (লগেন) কে ব্যঙ্গ করে তুলে ধরেছিলেন। তিনি বইটাতে ইয়ান্তে নামের একটা কাল্পনিক শহর সৃষ্টি করেছিলেন, যেখানে দশটা অলিখিত আইন চালু ছিল। আইনগুলো এমন: “তুমি ভেবো না তুমি বিশেষ কেউ, তুমি ভেবো না তুমি অন্যদের চেয়ে ভালো কেউ, তুমি ভেবো না তুমি অন্যের চেয়ে বেশি জানো…” ইত্যাদি।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, সেই উপন্যাস থেকেই “ইয়ান্তেলগেন” গোটা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সমাজে এক সাংস্কৃতিক প্রতীকে পরিণত হয় এবং পরে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সংস্কৃতিতে এক ধরনের সামাজিক মানসিকতা হিসেবে থেকে যায়। যদিও এটা কোনো সরকারি আইন না, তবু এটা সমাজের ভেতরের এক অদৃশ্য নৈতিক উপলব্ধি হিসেবে মানুষের মর্মবোধে পরিণত হয়েছে- কেউ অতিরিক্ত চোখে পড়তে পারবে না, কারণ সবাই সমান, সবাই একই সারিতে।
দেখলাম, সত্যিই তাই, সামাজিক শান্তির জন্যই শুধু না, বরং আত্মার শান্তির জন্যও নিজেকে নত করতে হয়। Stick inte ut তাই আমার কাছে হয়ে উঠেছে মুখহীনতার বাণী, অদৃশ্য হতে শেখা, নিজের বড়ত্ব থেকে ছোট হয়ে যাওয়া, অতঃপর বিন্দু হয়ে নিজের কাছে পৌঁছানো।
***
রুমি এক জায়গায় বলেছেন: “Be melting snow. Wash yourself of yourself.” - তুষারের মতো গলে যাও, নিজেকে নিজের ভেতর থেকে ধুয়ে ফেলো।
আমি দেখি, সুইডেনে আর অস্ট্রেলিয়া, উত্তর ও দক্ষিণের দুই ভুবনের শিক্ষা আসলে কোথায় যেন রুমির কথার ভেতরে গিয়ে মেশে। অস্ট্রেলিয়াতে, ''আওয়ার কমন বণ্ড'' মানুষকে মানুষের সঙ্গে মিশে সমাজের রেস্পন্সিব্যল অংশ করে তোলে, যে অরিজিন থেকেই আসো না কেন তুমি এই সমাজের অংশ হয়ে মিশে যাও, রাস্তার আইন মানো, দেশের আইন শৃংখলা মানো কারণ তুমি এই দেশের অংশ, তোমার ভালো থাকা না থাকা সমাজের জন্য ইম্পরট্যান্ট কারণ তোমার সাইকো-সোশ্যাল ইম্প্যাক্ট এই সমাজের ওপরও প্রভাব বিস্তার করে। সেই সাথে বিগত দিনের শিক্ষা, সুইডেনের Stick inte ut আমার কাছে হলো- অতিরিক্ত আলাদা না হয়ে, ডিস্ট্রাক্টেড না হয়ে নিজের বিন্দুতে পৌঁছনোর মর্মবোধ।
৭/৯/২০২৫