পূর্বকথা
শেষ পর্যন্ত বাক্সটা আমার হাতে আসল খুবই নাটকীয়ভাবে, বিয়েট্রিসের মাধ্যমে। সংক্ষেপে বলি।
কয়েক বছর আগে, জর্ডান্সপ্রিং আর গ্রিনওয়ে ক্রিসেণ্টের ক্রসিং এ দাঁড়িয়ে আছি। সবুজ লাইটের অপেক্ষা করছি, আর কয় সেকেণ্ডের মধ্যে সিগনাল গ্রীন হবে, এমন সময় বিকট ধাক্কা! আমার প্রথমটায় মনে হল আমার গাড়িতে বুঝি পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে পড়েছে। আসলে তখন কি যে মনে হয়েছিল, তা আজ আর মনে পড়ে না। যাইহোক, পরক্ষণেই বুঝলাম, আমার পেছনের গাড়ি দড়াম করে এসে হিট করেছে...
বলা নেই কওয়া নেই, সারি ধরে শান্তভাবে দাঁড়ানো গাড়ির ভিড়ে একটা গাড়ি এসে এমন দড়াম করে বাড়ি মারতে পারে, কি করে এমন হয়, আমি কোনও ধারনাই করতে পারছিলাম না। গ্রীন সিগনাল হয়ে গেল। হ্যাজার্ড লাইট অন করে আমি গাড়ি সাইডে পার্ক করলাম। পেছনের ড্রাইভারও পার্ক করল। আমার কনকাশন হলো কি না ভাবছিলাম, গাড়ি থেকে বের হতেই ভুলে গেছি যেন, এমন সময় পেছনের ড্রাইভার এসে আমার উইন্ডোতে কাতর চোখে টোকা দিল। আমি শকের ধাক্কা সামলে বের হয়ে আসলাম। মেয়েটা কাতর কণ্ঠে বলল, “আমি সত্যি খুবই দুঃখিত, আমার পা স্লিপ করেছে, আমি কিছু বোঝার আগেই এমনটা হলো। এই নাও আমার লাইসেন্স, এই নাও ইনস্যুরেন্স, ছবি তোলো, আসো গাড়ির পেছনটা দ্যাখো।”
এতক্ষণে আমার গাড়ির ড্যামেজের কথা মনে পড়ল। আমি মেয়েটার সাথে সেদিকে এগোতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কতখানি ক্ষতি হয়েছে ওখানে।” মেয়েটা বলল, “কিচ্ছু হয়নি।” আমি মনে মনে ধরে নিয়েছিলাম, গিয়ে দেখব আমার গাড়ির পেছনের অংশ একেবারে ধেবড়ে গেছে। কিন্তু অবাক ব্যাপার, গিয়ে দেখি আঘাতকারীর টয়োটা লেটারের হাল্কা উলটো ছাপ বাদে আর কিছুই হয়নি আমার গাড়িতে! এক কণা পরিমাণ ডেন্ট ও নয়!
মেয়েটা তারপরও ওর ফোন নাম্বার, লাইসেন্স নাম্বার, ইনস্যুরেন্স সব ইনফরমেশন দিল। আমি বাসায় ফিরে এলাম একসময়। এসে দেখি মেসেজ: “হাই, ইট্স বিয়েট্রিস। তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। আমি সত্যিই আবারও দুঃখ প্রকাশ করছি।”
আমি জানালাম, “ইটস ওকে, আরও খারাপ কিছু হতে পারতো, হয়নি যখন, তখন সত্যিই ঈশ্বরের কৃপা। টেক কেয়ার, ড্রাইভ সেফ।”
সেই ঘটনা থেকেই আমাদের বন্ধুত্বের সূত্রপাত। তারপর বিভিন্ন সময়ে আমরা বিভিন্ন অকেশনে গ্যাদারিং করেছি, গিফট এক্সচেঞ্জ করেছি, মুভি দেখতে গিয়েছি, প্রচণ্ড ব্যস্ত সময়ে হঠাত টেক্সট করেছি- চলো আজ লাঞ্চ আওয়ারে আধা ঘণ্টার জন্য রিচমন্ড ইন এ বসি, অথবা, সিক্রেট গার্ডেন নার্সারি তে গিয়ে গাছ দেখে আসি, বা হ্যক্সবারি নদীর ধারে একটু হেঁটে আসি। আমরা হয়ে উঠেছিলাম একে ওপরের একটা সিকিউর্ড করে রাখা বন্ধুর মতো, যখন কাউকে পাওয়া যাবে না, সবাই ব্যস্ত, তখন আমরা একে অপরের হাতের পাঁচ। সর্বদা অ্যাভাইলেব্যল, তারপর আবার হাওয়া হয়ে যাওয়া...
ফাস্ট ফরওয়ার্ড। বিয়েট্রিস একসময় কাজের প্রয়োজনে আমেরিকা চলে গেল। যাওয়ার আগে আমাকে বলল, এল্ডার হোমে নার্সিং করার সময় এক অশিতিপর বৃদ্ধা তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। মৃত্যুর আগে বৃদ্ধা তাঁর কিছু শখের জিনিস নার্সদের মধ্যে ভাগ করে দেন। তখন বিয়েট্রিসের ভাগ্যে পড়ে সেই বাক্স।
বাক্সটা প্রথমে কার হাতে ছিল, কোথায় পাওয়া গিয়েছিল- বৃদ্ধা নিজেও নিশ্চিত ছিল না। "একবার বলত কোনও গ্যারাজ সেল থেকে নাকি কিনেছিল, আবার কখনো বলত, অ্যান্টিক শপ থেকে, আবার বলত, তার বাবার এক নাবিক বন্ধু একসময় তার বাবার কাছে বাক্সটা রেখে গিয়েছিল," বলল বিয়েট্রিস, “ভাবলাম তোমার কাছে দিয়ে যাই। আমি আর কি করব এ দিয়ে, এ জিনিস বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। তোমার এইসব ব্যাপারে আগ্রহ আছে, তুমিই নাও। এইসব পুরনো চিঠি টিঠি আমার এমনিতেও সাথে রাখতে ভয় করে, হা হা হা…”
মোদ্দা কথায় বোঝা গেল, বাক্সটা বহু হাত ঘুরেছে। যাই হোক, বিয়েট্রিসের কাছ থেকে বাক্সটা নিলাম আমি। ভেতরটা সামান্য একটু চোখ বুলিয়ে আবার বন্ধ করে রাখলাম।
পড়ে ছিল ওটা আমাদের গ্যারাজের শেলফে বহুদিন। ইদানিংকালে আমার হঠাতই মনে পড়ল বাক্সটার কথা। গ্যারাজে গিয়ে, ধুলোটুলো ঝেড়ে ওটাকে ভেতরে আনলাম গতকাল। আজ ছুটির দিন। আমি ইদানিং চেষ্টা করছি, সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলতে এমন কিছু করতে যেটা আমার সপ্তাহের ডে-জবের থেকে একদম অন্যরকম। সেই প্র্যাক্টিসের অংশ হিসেবে, আমি ভাবলাম, দেখিই না বাক্সটা খুলে-
ভেতরে গুচ্ছ গুচ্ছ করে বেঁধে রাখা চিঠি। একটা গোছা তুলে নিয়ে ভাবলাম আচ্ছা একটু পড়েই দেখি। পুরাতন জিনিস, কাগজগুলো অনেক যত্ন সহকারে ধরতে হয়, পড়তেও হয় সেভাবেই, তাই প্রক্রিয়াটা সময়-সাপেক্ষ হবে। তবে সেই মুহূর্তে যেহেতু আমার ভুত চেপেছিল, তাই আমি আমার মাথায় চাপা ভুতের সম্মানেই, একটা চিঠি খুলে নিলাম। অনেক জায়গায় কালি ফিকে হয়ে গেছে।
আর মোটামুটি অন্যসব গোছায় কিছু সময় ধরে চোখ বুলিয়ে যা দেখলাম তাতে বুঝলাম অধিকাংশ চিঠিতেই আছে একটাই সম্বোধন “প্রিয় বন্ধু।” বন্ধুর নাম কি, প্রেরকেরই বা নাম কি, পেলাম না কোথাও। হয়তোবা পেয়েও যেতে পারি কোথাও। কোথাও তেমন কোনো নিষেধাজ্ঞা চোখে পড়লনা, যেন উদাসীন সেই প্রেরক কোনোভাবে জানত, কালের পরিক্রমায় তার চিঠিগুলো কখনও অপরিচিত কারও হাতে গিয়ে পড়বে। কেউ না কেউ এসব একদিন পড়বে।
যাইহোক সেখান থেকেই আজ আপনাদের কাছে তুলে ধরব এই চিঠিটা, প্রথমে যেটা চিঠিটা খুলে নিয়েছিলাম, সেটা।
একটা কথা বলে রাখি, চিঠিগুলো কোনও সাল-তারিখ বা সময়ের ধারাবাহিকতা না মেনে, আবার যখন যেভাবে আমার মনে হবে, চেষ্টা করব তুলে ধরতে, এভাবেই বাংলা অনুবাদ করে।
(স্থান ও তারিখের জায়গাটা ছিঁড়ে গেছে)
"প্রিয় বন্ধু,
বসন্ত যাই যাই করছে। আজ সকালে উঠে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি কি অনাবিল দৃশ্য! বাতাসে অশোকের ডাল দুলছে, বাগানে বসেছে পাখিদের মেলা। একেক পাখির একেক সুর। এই সময়ে মনে হল, তোমায় লিখি।
বসন্তে যে ছোট সবুজ কুঁড়ি হয়ে তুমি জন্মাও, বছর ঘুরে শীতকালে তোমায় খুঁজতে গেলে আর পাই না। কিন্তু কিছু মানুষ একটা কিছু দেখতে পায় সে গাছের নিচে, হয়তো বা তোমার ঝরা বীজ, হয়তো শুকনো পাপড়ি। গুটি কয়েক মানুষই শুধু তা চিনবে; বাকিদের কাছে তুমি কেবল ধুলো। ওই পর্যন্তই ঠিক আছে, বন্ধু, ওতে লোকসান নেই। ওই গুটি কয়েক মানুষের হাতেই চিহ্ন রেখে যেও।
কিন্তু তোমার বীজকে সর্বসম্মুখে সময় না আসতেই ফল রূপে হাজির করো না। অপ্রস্তুত পৃথিবীর সামনে ফল হয়ে প্রকাশিত হইয়ো না তুমি। স্মরণে রেখো, অন্ধকার ঘরে হঠাৎ প্রদীপের আলো জ্বলে উঠলে তা সহ্য করা যায়, কিন্তু অন্ধকার ঘরে হঠাৎ সূর্যের আলো এসে পড়লে, লোকের চোখ ঝলসে যায়।
বন্ধু আমার, ইতিহাসের সকল শঙ্খধ্বনি সভ্যতা সহ্য করতে পারেনি। যেইখানে দৃষ্টি সীমাবদ্ধ, যেইখানে চিন্তা নির্দিষ্ট ছন্দে অভ্যস্ত, সেইখানে আলোও অন্ধকারেরই আরেক নাম। সেইখানে মানুষের গ্রহণক্ষমতা জীবন্ত এক অঙ্গের মতো, হঠাৎ অতিরিক্ত পুষ্টি সহ্য করতে পারে না সেই অঙ্গ।
তাই, তোমার বীজ হতে ফল দিতে সময় নিও, বন্ধু। তোমার চিন্তাকে বজ্রধ্বনি কোরো না কখনোই, তোমার আলোকে স্তরে স্তরে মেলে ধরো, প্রথমে প্রদীপ, তারপর মশাল, তারপর ধীরে ধীরে দিনের আলোর মতো প্রকাশিত হইয়ো।
আজ বিদায় নিচ্ছি। ভালোয় থেকো, আলোয় থেকো।
শুভকামনায়,
তোমারই একান্ত আপনজন "
(চলবে)