মাদের দেশের সমাজে প্রকাশ্যে কোনও ব্যক্তিকে সমালোচনা বা অপমান করার প্রবণতা যেন এখনকার এক অমোঘ রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রবণতাকে জনসাধারণ সাদরে গ্রহণ করেছে, কারণ এর থেকে সহজ মানসিক তৃপ্তি ও বিনোদন আর কিছুতে পাওয়া যায় না। যেন কোনও এক ব্যক্তির সম্মান ক্ষুণ্ন করা, তার পেশাদার গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় তাকে টেনে আনা, আর সেখান থেকে একের পর এক তার ভাইরাল ভিডিও বানানো - এটাই এখন সামাজিক বিনোদন।

 

সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল অঙ্গনে একদল তথাকথিত সংবাদ উপস্থাপক জন্ম নিয়েছে, যারা খবর না, বরং 'কেলেঙ্কারি' ধরার নেশায় মত্ত। তারা সমাজের কোনও একটা ঘটনা বা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে খবর বানায়, সেটা প্রকাশ করে, এবং জনসাধারণ সেই বিষয়ের ওপর তাদের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়। এই প্রতিক্রিয়া কোনো নির্দিষ্ট পেশার মানুষ বা সেলিব্রেটির বিরুদ্ধে হতে পারে, আবার তা হতে পারে একেবারেই সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে।

 

পাব্লিক শেইমিং কিন্তু নতুন কিছু নয়। সভ্যতার শুরু থেকে সমাজে এটা একটা প্রাচীন শাস্তির রূপ ছিল। প্রাচীন চীনে অপরাধীদের ‘ক্যাঙ্গ’ নামের কাঠের কলার পরিয়ে জনসাধারণের সামনে প্রদর্শন করা হতো। উপস্থিত জনতা তখন তাদের বিদ্রুপ করত। ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতায় অপরাধীদের মাথা ন্যাড়া করে জনসমক্ষে এনে উপহাস করা হতো। ইংল্যান্ডে আলকাতরা এবং পালক প্রথার প্রচলন ছিল, যেখানে অপরাধীকে নগ্ন করে আলকাতরায় ডুবিয়ে পালকে ঢেকে সমাজের সামনে উপস্থাপন করা হতো। মধ্যযুগীয় ইউরোপে পিলোরি নামের কাঠের যন্ত্রে অপরাধীর মাথা ও হাত আটকে জনসাধারণের গালিগালাজের সামনে দাঁড় করানো হতো। এইসব শাস্তির উদ্দেশ্য ছিল অপরাধীকে শুধুমাত্র শাস্তি দেওয়া না, বরং জনসমক্ষে তাকে চরমভাবে অপমানিত এবং লাঞ্ছিত করা।

 

আজকের ডিজিটাল যুগেও এই প্রথা কোনোভাবে হারিয়ে যায়নি। বরং আরও মারাত্মক রূপে ফিরে এসেছে। আমরা এক ক্লিকেই অন্য কারও জীবনকে বিশ্লেষণ করতে পারি। তাদের ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে অনুপ্রবেশ করে সেটাকে টেনে পাবলিক প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসি। একবার কোনও ছবি বা ঘটনা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লেই সেটা জনসাধারণের হাতে অস্ত্র হয়ে দাঁড়ায়। কোনও একটি ইস্যু পেলেই সেই ব্যক্তির ছবি ''ডিজিটাল পিলোরি''তে আটকে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে  সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় পাতায়। এরপর সেই ব্যক্তিকে নিয়ে শুরু হয় ডিজিটাল রাস্তার অলিগলি বেয়ে টানা-হেঁচড়া করা প্যারেড। সেটা শহরময়, সমাজময়, দেশময়, বিদেশময় চলতে থাকে। সেইসব প্যারেডে অংশ নেয় অসংখ্য সাধারণ মানুষ। অলিগলি থেকে বড় রাস্তা, মহাসড়কের দুপাশে তারা দাঁড়িয়ে থাকে তীব্রভাবে গালিগালাজ করার জন্য। ইমোটিকনের মাধ্যমে বিভিন্ন বস্তু নিক্ষেপ করার জন্য রেডি হয়ে থাকে অসংখ্য মাথামোটা মানুষ।

 

 

এই প্রাচীন অভিশাপে, আজ দেশের ডিজিটাল সমাজও জর্জরিত। পাব্লিক শেইমিং এর প্রতিটি ক্লিক, প্রতিটি মন্তব্যের পেছনে একটি মানুষের জীবন লুকিয়ে আছে- একথা আপনি কাকে বোঝাবেন…