সেদিন দেখলেন না, কোলের ওপর ল্যাপটপ নিয়ে বসার ছোট টেবিল? নাম তার ল্যাপডেস্ক। সত্যিইতো কোলের ওপর ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করা কি ঠিক, জীবনেরর মানোন্নয়ন বলে তো কিছু আছে, নাকি! এতো ঘাটের জল খেয়ে শেষকালে কোলের ওপর গরম ল্যাপটপ, উরুতে গরম লাগে না! না না আজই চাই সেই ল্যাপডেস্ক! দুদিন পরের কথা, আপনি দেখে এলেন নাকি গুগলই আপনাকে দেখাল ঠিক মনে নেই- ল্যাপডেস্কের মতোই আরেকটা বস্তু, ল্যাপের ওপরই সুন্দর মতো এঁটে বসে, কিন্তু তাতে প্লেট রাখার জায়গাটার একপাশে গ্লাস রাখার জন্য কি সুন্দর গোল করে সাঙ্কেন করা, ওমা আরেকদিকে আবার কফির মগ রাখার জন্য আরেকভাবে নকশা কাটা, আপনার মনে হলো- অবশ্যই, কেন নয়, এতো কষ্ট করে আয়-রোজগার করা, শয়নস্থান থেকে উঠে বসে, মানে আধশোয়া হয়ে উইকেণ্ডে প্রাতঃরাশ সারবো না এ আবার কেমন কথা! কিনে নিয়ে বাড়ি ফিরছেন, স্ক্রল করতে করতে দেখলেন, আপনার পরিচিত একজন একটা চমৎকার রেস্তোরাঁর এক কোণে বসে, লেকভিউ টাইপের একটা সেলফি তুলেছে, ক্যপশন দিয়েছে- ‘’জীবনের আনন্দের সুতো জড়িয়ে আছে আমাকে, আমি সেই সুরে নাচি ভোরের আলিঙ্গনে, জানে, সেকথা, শুধু তোমার হৃদয় জানে।‘’
আনন্দের সুতো কি জিনিস, আনন্দের সুতোর আবার সুর হয় কি করে, সেই সুরে ভোরের আবার আলিঙ্গনে...ধুর...আপনার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। আপনার মনে হলো নাহ, একটা বিহিত করা দরকার, অবচেতন মন আপনাকে বোঝাল, ‘আরে এত চিন্তা কিসের, একটা কিছু কেনো, নিজেকে ট্রীট দাও, এইসব ছাতামাথা মানুষ, পোস্ট এইসব কি জীবনে কম স্ট্রেস দেয়! কেনো। একটা কিছু কেনো।‘
কি কেনা যায় আপনি ভাবতে থাকলেন। ভাবতে ভাবতে, কয়েকদিন পর আসলো সমাধান, আইডিয়াটায় আপনার শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ খেলে গেল, ছবিটার ক্যাপশন কি হবে ভাবতে থাকলেন, ভাবতে ভাবতে আপনার মনের অতলান্তিকে দানা বেঁধে উঠল কষ্টেসৃষ্ট কথামালা- ‘’এক নদী, দুই ভাটা, ডুব দেই, ডুব দেই’’। আপনার আদর্শের উত্থানের সাথে আত্মবিশ্বাসের মিলনে আপনি খুঁজে পেতে একটি সংক্ষিপ্ত পোশাক ‘ক্রয়’ করলেন, এবং সেই পোশাক পরিধান করে আত্মপ্রকাশিত হলেন, ছবির ক্যাপশনে লিখলেন ‘’এক নদী, দুই ভাটা, ডুব দেই, ডুব দেই’’।
কাব্যটুকুর কল্যাণে নয়, সংক্ষিপ্ত বস্ত্রায়নের দাক্ষিণ্যে আপনি ভাইরাল হয়ে গেলেন। এমন করে কদিন গেল, কিন্তু একসময়, আপনি যা না, যা চালিয়ে যেতে পারলেন না, সেই ময়ুরপুচ্ছ খসে পড়ল, আপনি আবার আপনার সামাজিক আদর্শের ঘেরাটোপে পুরাতন কাপড়গুলো ফের খুঁজে নিলেন।
আপনার মনে ততদিনে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে মানুষকে শক দেওয়ার নেশা। আপনি ভাবলেন, নাহ, ওমুক তমুক যা পারে না আমি তাই করে দেখাব, কিন্তু কি সেটা, ভাবছেন ভাবছেন, কূলকিনারা করতে পারছেন না, ভাবতে ভাবতে ঠিক করলেন- বিলাসবহুল বিছানার পাশে সুগন্ধযুক্ত মোমবাতি জ্বালিয়ে স্বামী-স্ত্রী তে আধশোয়া হয়ে একখানা ফটো তুলে সবাইকে দেখাতে পারলে কেমন হয়!
কিনতে হবে আরও কত কি কিনতে হবে! জড়োয়া ডিজাইনের বেডকভার কিনলেন, বডিজ ড্রেস কিনলেন, ব্লাঙ্কেট লাগবে তো, নরম প্যাস্টেল রঙের কাশ্মীরি কম্বল আসলো, তাতে টকটকে লাল ভেলভেট সুতো দিয়ে এমব্রয়ডারি করা ছোট ছোট গোলাপ ফুল। কি দারুন দেখতে সেই কম্বল!
একটা প্রি-স্ট্যাটাস দিতে মন্দ কি, লিখলেন – ‘রাতের ঠান্ডা কোমল আরামে উষ্ণতার ফিসফিস এই কাশ্মীরি কম্বলটি পাঠিয়েছে ছোট বোন বা ভাই ওমুক তমুক’ ইত্যাদি লিখে ট্যাগ করলেন সেই ভাইবোনদের, না করলেও সমস্যা, ইনবক্সে তারা মেসেজ পাঠায়- ‘আপি, পোস্টটি ভালো লেগেছে আমাকে ট্যাগ করো’
তারপর কাশ্মীরি কম্বলের পোস্টের নিচে সেই ছোটভাই বা বোনটি কমেণ্ট করলো, ‘আপি, সামনের মাসে মাইক্রোপ্লাশ লাভ-লেটার ব্লাঙ্কেট আসবে কিন্তু’
কিন্তু আপনার সেই ফটোটির কি হবে, কে তুলবে সেই ফটো, ওইযে স্বামী-স্ত্রী তে আধশোয়া হয়ে, বিলাসবহুল বিছানার পাশের টেবিলটায় সুগন্ধযুক্ত মোমবাতি জ্বালিয়ে...ওই ফটোটা
আরে তাইতো! সবই রেডি, কিন্তু সুগন্ধি মোমবাতি তো...। চিন্তা কি! কিনুন! কিনতে হবে যে, না কিনলে কিভাবে হবে! সুগন্ধি মোমবাতিও আসলো, কত ধরণের সুগন্ধই না সেই মোমবাক্সটিতে; হুইস্পার উড, মিডনাইট জেসমিন, ভ্যানিলা ড্রিম... কত কি!
আপনি আপনার প্রাণের মানুষ কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ও গো, এক ছবিতে সব মোমবাতি আনবো কি করে, আর এতসব ঘ্রাণই বা লোকে বুঝবে কি করে!’
প্রাণের মানুষটি তখন বললেন, ‘আহ এ আর এমন কি! ক্যাপশনে লিখে দিও- ‘’রোববারের দীর্ঘশ্বাস ভ্যানিলা ড্রীম, সোমবারে অ্যাম্বার মোম-ভোরে উঠব যেদিন, ঘুমচোখে তুমি বোলো, ‘’তুমি’’ আমার মঙ্গলের মিডনাইট জেসমিন’’...’
‘ও...য়াও দারুন! তুমি না, এত ভালো বাংলা, মানে কি বলব! ইস...’
‘কি ভাবো কি তুমি আমাকে অ্যাঁ? কলেজে থাকতে একবার- এ টিয়ার ড্রপ অন দ্য ফেস অব এটারনিটির মানে কেউ পারলো না, আমি হাত তুলে বললাম, স্যার, মানে হবে- ‘কালের কপোলতলে এক ফোঁটা অশ্রুবিন্দু’ ’
‘আচ্ছা যাইহোক তারপর?’ আপনি বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
‘তার আবার পর কি?’
‘না মানে, আরও মোম থেকে গেল যে!’
‘ওহ হো। আচ্ছা লিখে নাও... উম... কোনবার পর্যন্ত বলেছি বলতো?
আপনি একটু ভেবে বললেন, ‘ ’তুমি’ আমার মঙ্গলের মিডনাইট জেসমিন’ এই পর্যন্ত বলেছ।’
‘আচ্ছা লেখ... উম... ‘’বুধবারে ক্ষয় হয় সাভানা গ্লীম’’ মোমগুলোর নাম পড়তে পড়তে আপনার সঙ্গী বলে চলেছেন, ‘অ্যাম্বার সানসেটে বৃহস্পতি, শুক্রবারের উষ্ণ আলিঙ্গনে এমা ছি ছি, ছি ছি ভ্যানিলা ড্রীম...’
‘ও...য়াও! আর শনিবার?’
‘উম, বাকি মোম তো আরও ছয়টা আছে, আচ্ছা এই মোমটা নিয়ে লিখ – ‘স্টার হুইস্পার সর্বনেশে শনিবার’
‘ইস তুমি না, এতো ভালো মানে কিভাবে যে...!’ আপনি বিগলিত কণ্ঠে বললেন।
‘দেখো, সেই ছবি একেবারে ভাইরাল হয়ে যাবে!’
‘তা তো অবশ্যই, দেখি এবার কেউ আর এমনটা পারে কিনা’ বলতে বলতে আপনার মাথায় নতুন চিন্তা এলো, সঙ্গীপ্রবরটিকে কি করে একটা সারপ্রাইজ দেয়া যায়!
কেন, গতকাল একটা পোস্ট দেখেছেন মনে নেই? ‘কাঁদুনি বউ-পিঠা মিক্স’। আজই অর্ডার দিতে হবে, বউ-পিঠা বানিয়ে কর্তাকে একেবারে তাক লাগিয়ে দেবেন, টপিং এ দিতে হবে আখরোটের গুঁড়ো, গোলাপের পাপড়ি, গ্রেট করা সাইট্রাস জেস্ট দিলেও মন্দ হয় না। দেরি করা যাবে না, আজই অর্ডার করতে হবে সব... ‘ইস্, কি জানি সাইট্রাস জেস্ট পাওয়া যাবে কি এই ছাপোষা মার্কেটপ্লেসগুলোতে কে জানে’, ভাবতে ভাবতে আপনি আনমনে স্ক্রল করতে থাকলেন... একটা পোস্টে এসে আপনার চোখ আটকে গেল;
আপনার কোন ফেলে আসা দিনের ডাব্বা মারা এক বান্ধবী, যে দু কলম ঠিকমতো বাক্য গঠন করতে পারে না, তবু যার লাখ লাখ ফ্যান ফলোয়ার, সে পড়ন্ত বেলায় ওই ডুবন্ত সূর্যের দিকে রাজহংসীর মতো গ্রীবা উঁচু করে তাকিয়ে আছে, পড়নে গভীর নেকলাইনের আধখোলা নীল টপ আর সাদা রঙের অনেকটা সি-থ্রু জগার্স। সে লিখেছে- ‘’শুধু কোনও ছুম্বনে মনে রেখো বন্ধু, মন্দু হাওয়া ছুমে যায় ছুমে যায় তুমি তবু অন্ধু‘’ ফটো কার্টেসী- ‘পিক অ্যা বু ফটোগ্রাফীর Ahakil Zuffadir ভাইয়া।‘’
আপনার তখনি মনে হলো এই Ahakil Zuffadir ভাইয়া কে বুক করতে হবে, পড়ন্ত সূর্যের আলোয় এমন ভালো ছবি যে তুলতে পারে, আতরগন্ধী মোমবাতির স্বল্পালোকিত কক্ষে স্বামী-স্ত্রীর তে আধশোয়া সেই ছবিটার জন্য এনাকেই লাগবে...
আপনি পিক অ্যা বু ফটোগ্রাফীর পেইজে ঢুকে মেসেজ লিখতে শুরু করলেন, ‘ভাইয়া...’ ইত্যাদি।
ডিসক্লেইমার:
এই লেখায় ব্যবহৃত কোনও নাম, চরিত্র, ঘটনা বা পরিস্থিতির সঙ্গে বাস্তব জীবনের কোনও ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা ঘটনার মিল সম্পূর্ণ কাকতালীয়। লেখাটি নিছক রম্যরচনা এবং বিনোদনের উদ্দেশ্যে রচিত।